সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, মিতু হত্যাকাণ্ডের রহস্য ইতোমধ্যেই উদ্ঘাটিত হয়েছে। আসামি শহিদুল (৩০) পুলিশ হেফাজতে আছে। এ ছাড়া অপর আসামি ইব্রাহিম (৪৫) শিগগিরই ধরা পড়বে।
ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) দীন ইসলাম বলেন, মিতুকে ১৬ সেপ্টেম্বর হত্যা করা হয়। পরদিন তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর সন্দেহভাজন হিসাবে ঝালকাঠি থেকে কামরুল ও ফোরকানকে আটক করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের হয়ে আসে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত আরও দুজনের নাম বেরিয়ে আসে। তারা হলো শহিদুল ও ইব্রাহিম। পরদিন তাদের নামে মামলা করেন মিতুর বাবা নুরুল ইসলাম। ২১ সেপ্টেম্বর আদালতে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওইদিন শহিদুলকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শহিদুল এখন থানা হেফাজতে আছে।
মঙ্গলবার আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কামরুল জানায়, ২০০৯ সালে পারিবারিকভাবে আমি মিতুকে বিয়ে করি। মিতু ঝালকাঠিতেই থাকত। বিয়ের পর মিতু অন্য পুরুষের সঙ্গে আমার সামনেই হাত মিলাত। এতে আমি মনঃক্ষুণ্ন্ন হই। পরে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসি। যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সেখানেও একটি ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক হয়। এটি সহ্য করতে না পেরে তাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে ভুলতা চলে যাই।
সেখানে আমি সাত হাজার টাকা বেতনে গার্মেন্টে চাকরি শুরু করি। আর ১২ হাজার টাকা বেতনে মিতু চাকরি নেয়। সেখানে শিহার নামে একজনের সঙ্গে তার প্রেম হয়। বিষয়টি জানার পর আমি একদিন মিতুকে মারধর করি। মিতু কৌশলে আমাকে পিরোজপুরে নিয়ে আদালতে মামলা করে। পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে সমঝোতা করে তাকে নিয়ে ঢাকায় আসি। এরপর আমার সহকর্মী সালাউদ্দিনের সঙ্গে মিতু পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে।
জবানবন্দিতে কামরুল আরও জানায়, ছয় বছর আগে আমি কেমিক্যাল ব্যবসা শুরু করি। আমার কোম্পানির নাম কেএম কেমিক্যাল। আমি ওই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং মিতু চেয়ারম্যান। ওই ব্যবসা শুরুর পর আমাদের সংসারে সচ্ছলতা আসে। তবে সংসারে অশান্তিও চলতে থাকে। ১ সেপ্টেম্বর আমি লঞ্চে বরিশালে যাই। আমার সঙ্গে ছোট ভাই ফোরকান ছিল। এদিন আমার মন ভীষণ খারাপ ছিল। ফোরকান এর কারণ জানতে চাইলে আমি সাংসারিক অশান্তির কথা বলি। তখন ফোরকান আমাকে প্রশ্ন করে ‘মিতুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে কেমন হয়?’ আমি বলি, যদি তাকে সরিয়ে দিতে পারি তাহলে খুব ভালো হয়। তখন ফোরকান বলে সাত লাখ টাকা দিলে মিতুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া যাবে। আমি প্রথমে তাকে চার লাখ টাকা ও পরে পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি হই। পরে আমার ও ফোরকানের পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের ছক আঁকা হয়। কিলার ভাড়া করে ফোরকান। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি বরিশালে থেকে যাই। ফোরকান ঢাকায় চলে আসে। ঘটনার দিন ব্যাংক থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে পূর্বপরিচিত ইব্রাহিমকে দেওয়ার জন্য মিতুকে বলি। আইএফআইসি ব্যাংক সারুলিয়া শাখা থেকে টাকা তুলে মিতু ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় গ্লোরি বাস কাউন্টারের সামনে যায়। তখন ফোরকান, শহিদুল ও ইব্রাহিম মিলে মিতুকে গাড়িতে তুলে নেয়। পরে ফোরকান আমাকে মোবাইল ফোনে বলে- আর তোমাকে কেউ জ্বালাবে না। কাজ শেষ!
কামরুল আরও বলে, গাড়িতে তোলার পর মিতুকে প্রথমে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়। তার গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ফোরকানের কাছ থেকে ঘটনা জানার আধা ঘণ্টা পর আমি আমার শ্বশুরকে ফোনে বলি, মিতু ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়েছিল। এরপর থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ও আমার শ্বশুর থানায় গিয়ে জিডি করি।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে একই ধরনের তথ্য দিয়েছে ফোরকান। সে বলে, ভাইয়ের কাছ থেকে তার দুঃখের কথা শুনে ভাবিকে হত্যার পরিকল্পনা করি। পরিকল্পনা অনুযায়ী কিলার ও মাইক্রোবাস আমি সংগ্রহ করি। গাড়িচালক বিষয়টি জানত না। হত্যার পর সে জানতে পারে। পরে তাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে লাশ নিরাপদ দূরত্বে ফেলে রাখা হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়- মিতুর সঙ্গে ১২ বছর আগে কামরুলের বিয়ে হয়। মৌলি নামে তাদের নয় বছরের এক মেয়ে আছে। বিয়ের পর ৪-৫ বছর মিতু ও তার স্বামী গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে ছিল। ৭-৮ বছর ধরে স্বামী ও মেয়ে নিয়ে মিতু ডেমরা থানা এলাকায় বসবাস করছিল। ৩-৪ বছর আগে কামরুল কেমিক্যালের ব্যবসা করে। কামরুল বেশি পড়ালেখা না জানায় তার ব্যবসার হিসাব রাখত মিতু। ৩-৪ বছর ধরে বিভিন্ন তরুণীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি করে কামরুল। এতে মিতুর সংসারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে কামরুল তার পথের কাঁটা মিতুকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল মর্গে মিতুর লাশ শনাক্ত করা হয়।